কক্সবাংলা ডটকম(১৪ নভেম্বর) :: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুলপ্রত্যাশিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ ও দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন উদ্বোধন করেছেন। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজার রাজধানীর সঙ্গে রেলপথে যুক্ত হচ্ছে। কক্সবাজারে রেলপথ স্থাপনের চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৩৩ বছর আগে ১৮৯০ সালে। তারপর ব্রিটিশ-পাকিস্তানি দুঃশাসন শেষে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর স্বপ্নের সেই রেলপথ তৈরি ও চালু সম্ভব হলো বর্তমান সরকারের আমলে।
শনিবার দুপুর ১টায় উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কথা দিয়েছিলাম, কথা রাখলাম। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ হলো। রেল সংযোগে অন্তর্ভুক্ত হলো দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজার। মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল রেললাইন নির্মাণ। সেই রেললাইনের উদ্বোধন হলো। প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে আইকনিক রেলস্টেশন এবং এরপর ১০১ কিলোমিটার দীর্ঘ দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের উদ্বোধন করেন।
আইকনিক রেলস্টেশন ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এসব প্রকল্পে মোট ব্যয় হচ্ছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেলের উদ্বোধনও করেন। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ শুধু ওই এলাকা নয়, পাল্টে দেবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে এ গভীর সমুদ্রবন্দর।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার লাইন বাংলাদেশ রেলওয়ের এমন একটি রেলপথ যেখানে যাত্রাপথে কখনো চোখে পড়বে নদীর সৌন্দর্য। মুগ্ধ করবে টিলাপাহাড়ি এলাকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। যেতে যেতে কখনো দুই ধারে দেখা মিলবে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চলতি পথের এই মনোরম পরিবেশ দেখার সুযোগ করে দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এই রেলপথ পর্যটন খাত ছাড়াও কক্সবাজারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে এই অঞ্চলের মৎস্য সম্পদ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ পণ্য পরিবহনব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক সহজ হবে। ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
কক্সবাজারের নতুন রেলপথে চলাচলের সময় ট্রেনে বসেই মানুষ অনায়াসে দুই পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে। দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আইকনিক রেলস্টেশনে থাকছে লাগেজ স্টেশন, অভ্যর্থনা কক্ষ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ, শপিংমল, রেস্তোরাঁ। একই দিনে কোনো হোটেলে অবস্থান না করে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ঘুরে আসার সুযোগ পাবেন পর্যটকরা। ঢাকা থেকে সাড়ে সাত ঘণ্টায় এবং চট্টগ্রাম থেকে আড়াই ঘণ্টায় যাওয়া যাবে কক্সবাজারে। এর ফলে বিশে^র বৃহত্তম সমুদ্রসৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় বাড়বে। বয়ে আনবে পর্যটনের সুদিন।
কক্সবাজারের ঝিলংঝা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়া এলাকায় তৈরি হয়েছে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক ভবন। এটি দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন। ২৯ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা রেলস্টেশন ভবনটি ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুটের। ভবনটি ছয়তলা। মূল ভবনের সামনে খোলা মাঠে তৈরি হয়েছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। এ স্টেশনটিতে পর্যটকরা লাগেজ স্টেশনে রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকত এবং দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন নিজ গন্তব্যে।
এ ছাড়া ভবনটিতে থাকবে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, তারকা মানের হোটেল ও কনফারেন্স হল। আইকনিক এই স্টেশনটি নির্মাণের সময় চীন, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী নিয়োজিত ছিলেন।
কক্সবাজারে পর্যটকদের অর্ধেকই আসেন এক দিনের জন্য। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। এ ছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা; থাকছে সাধারণ ও ভিআইপিদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ড্রপ এরিয়া; বাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এবং থ্রি-হুইলারের জন্য আলাদা পার্কিং এরিয়া; থাকছে সুপার মার্কেট, ফার্মেসি, এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ, ফরেক্স সেবা সার্ভিস ছাড়াও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা কেন্দ্র।
এখন বছরজুড়েই কক্সবাজারে পর্যটকরা আসেন। তবে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যটকের আগমন বেশি। রেলের মতো নিরাপদ বাহন চালু হলে মৌসুমের বাইরেও পর্যটক বাড়বে। পর্যটক যত বাড়বে, তত কেনাবেচা বাড়বে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্যের বিক্রি বাড়বে। লেনদেনও বাড়বে।
পর্যটনের পর কক্সবাজারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কয়েকটি খাত হলো-লবণ, কৃষিপণ্য, মৎস্য ও শুঁটকি। এসব পণ্য কম খরচে আনা-নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কৃষিপণ্য সহজে আনা-নেওয়ার সুবিধা থাকলে কৃষকদেরও দাম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের গতি আনবে নতুন রেললাইন।
দোহাজারী-কক্সবাজারে রেল সংযোগ কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের বহুমুখী যোগাযোগের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করবে। কক্সবাজার স্মার্ট সিটিতে পরিণত হবে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পে পাল্টাবে অর্থনীতির চাকা। কক্সবাজার একটি বিকাশমান জেলা শহর। ঢাকা টু কক্সবাজার সরাসরি ট্রেন চলাচল কক্সবাজারের আরও বেশি দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন হবে। পাশাপাশি বহুমাত্রিক উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হবে। এতে অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন আসবে।
Posted ১:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta